খাবার খরচের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিত জঙ্গিরা

প্রকাশিত: ৪:৪৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০২২

খাবার খরচের বিনিময়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিত জঙ্গিরা

সুরমা মেইল ডেস্ক :
মাসে ৩ লাখ টাকা আর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহনের বিনিময়ে জঙ্গিরা পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিত বলে জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

 

শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বেলা ১১টায় বান্দরবানের র‌্যাব কাম্পে ব্রিফিংয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।

 

তিনি বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের গ্রেফতারকৃত ৩ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়- তারা কেএনএফ (কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এর সামরিক শাখা কেএনএ-এর সদস্য। ‘কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামক সশস্ত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নাথাং বমের সঙ্গে ২০২১ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমিরের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পার্বত্য অঞ্চলের কেএনএফ-এর ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার-এর সদস্যদের আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লক্ষ টাকা এবং কেএনএফ এর সকল সদস্যের খাবার খরচ বহন করা হত।’

 

ব্রিফিংয়ে র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন তরুণ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। র‌্যাব এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গোয়েন্দা কার্যক্রমে র‌্যাব ফোর্সেস জানতে পারে, আরও বেশ কয়েকজন তরুণ ঘর ছেড়ে উগ্রবাদের উদ্দেশে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি টিম বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া এরকম ৪ তরুণকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে ডি-র‌্যাডিক্যালাইজড করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

 

এছাড়াও, ইতোমধ্যে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ এক তরুণ নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লাসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিখোঁজ ৪ জন তরুণ ও উগ্রবাদী সংগঠনের দাওয়াতী, তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় প্রদান ও অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ৩ জনসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরাণীগঞ্জ থেকে উগ্রবাদী সংগঠনটির দাওয়াতী ও অন্যতম অর্থসরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ ও নিরুদ্দেশ ৩ তরুণসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতরা উগ্রবাদী এই সংগঠন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।

 

গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নামকরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। হুজিবি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে সদস্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছিল বিধায় তারা সংগঠন থেকে বের হয়ে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিকভাবে উগ্রবাদী এই সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কোমলমতি তরুণদের টার্গেট করত। তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ভিডিও এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করা হত। এরপর এই তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলতে বিভিন্নভাবে মোটিভেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করা হত।

 

র‌্যাব জানায়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নিখোঁজ তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হয়। এ সময় নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদেরকে বিভিন্ন সেইফ হাউজে রেখে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। প্রশিক্ষণকালীন বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত। এছাড়া আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদেরকে রাজমিস্ত্রী, রং মিস্ত্রী, ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত।

 

র‌্যাব আরও জানায়, নিখোঁজদের কারও কারও পরিবার জানত, তারা চাকরির জন্য বিদেশে অবস্থান করছে। বিভিন্ন সময় পরিবারের নিকট অর্থও প্রেরণ করত তারা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ছত্রছায়ায় দুর্গম অঞ্চলে আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বিভিন্ন নাশকতা ও সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনাসহ সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েকদিন যাবৎ বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে র‌্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়। গতকাল রাতে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্বে র‌্যাব-৭ ও র‌্যাব-১৫ অভিযান পরিচালনা করে ১০ জনকে আটক করে।

 

গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক উগ্রবাদী সংগঠনে জড়িত হয়ে তারা দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এদের মধ্যে কেউ নিকটাত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ স্থানীয় ব্যক্তি বা পরিচিতজনদের মাধ্যমে উগ্রবাদী এই সংগঠনে জড়িত হয়। ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক উগ্রবাদি জঙ্গি সংগঠনে যোগদান করে কথিত হিজরতের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধাপের কর্মকেন্দ্রিক স্তর অতিক্রম করে উত্তীর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নিখোঁজ হওয়া যুবকরা প্রশিক্ষণের জন্য আসে বলে জানা যায়।

 

সংগঠনের সদস্যরা তাদেরকে উগ্রবাদে উৎসাহী করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন এলাকায় শারীরিক প্রশিক্ষণ ও তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদানের জন্য পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জ্যেষ্ঠ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেইফ হাউজে রাখত। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ তরুণদেরকে বান্দরবানের দুর্গম পার্বত্য এলাকায় পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হত। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত।

 

জানা যায়, বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় পরবর্তী ধাপের প্রশিক্ষণে তাদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, আইইডিসহ বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরি, চোরাগুপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ নানা ধরনের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞান বিষয়েপ্রশিক্ষণ প্রদান করা হত।

 

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ শিবিরে মোট প্রশিক্ষণার্থী ৫০ এর বেশি। ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সংগঠনটির আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি। এছাড়া উগ্রবাদী এই সংগঠনে ৬ জন শূরা সদস্য রয়েছে যারা দাওয়াতী, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে। শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতী শাখার প্রধান, মাসকুর রহমান সামরিক শাখার প্রধান, মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার ২য় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে। তারা অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য তারা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়।

 

অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের গ্রেফতারকৃত ৩ জন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা কেএনএফ (কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এর সামরিক শাখা কেএনএ এর সদস্য। গ্রেফতারকৃত জৌথান স্যাং বম, স্টিফেন বম ও মাল সম বম সকলেই ‘কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’-এর সদস্য। যারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’-এর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

 

গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে ব্রিফিংয়ে জানায় র‌্যাব।


সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  

লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

রাফি গার্ডেন সুপার হোস্টেল।

 

আমাদের ভিজিটর
Flag Counter

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com