ভাগ্যরজনী পবিত্র শবে বরাতের ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়

প্রকাশিত: ৩:৩৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ৬, ২০২৩

ভাগ্যরজনী পবিত্র শবে বরাতের ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়

মোহাম্মদ মকিস মনসুর :
লেখার শুরুতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করছি সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানদের এবছরের ৩০ টা রোজা, ৩০ টা সেহরি, ৩০ টা ইফতার, খতমে কোরআনের সাথে ৩০ টা তারাবির নামাজ, ইসলামের সঠিক আকিদা ও নিয়মকানুন মেনে আদায় করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
দীর্ঘদিন পর এবছরের রামাদান আমার প্রিয় জন্মমাটিতে পালন করার উদ্দেশ্যে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, সহিসালামতে আমাদের সফর যেনো হয় এজন্য সবার কাছে দোয়ার আবেদন জানাচ্ছি।

 

ইসলামী তমদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে ৫টি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ ৫টি রাত হলোঃ দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর।

 

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রজনী যেটাকে বাংলাদেশের মানুষ শবে বরাত নামে অভিহিত করে সেটা হচ্ছে ৭ মার্চ, মঙ্গলবার দিবাগত রাত। বাংলাদেশের আকাশে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার পবিত্র শাবান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বুধবার থেকে পবিত্র শাবান মাস শুরু।

 

মুসলিম সম্প্রদায়ের সৌভাগ্যের রজনী বা ভাগ্য পরিবর্তনের রাত এই পবিত্র শবে বরাত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য লাভের আশায় এই রাতে নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত ও দোয়া সহ বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে রাতটি অতিবাহিত করেন। এই রাতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন।

 

‘শবে বরাত’ ফারসি শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত বা রজনী। আর ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য। দু’টো শব্দ একত্রে করলে হয় ‘ভাগ্যের রাত বা ভাগ্যের রজনী।

 

আমাদের প্রিয় বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) (আঃ) এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন্ নিসফি মিন শাবান’ বা ১৫ শাবানের রাত বলেছেন। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহঃ)

 

মর্যাদাপূর্ণ এ রাতে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন। এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তা’আলা পাপী বান্দাদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত অর্থাৎ ভাগ্যের রজনী বলা হয়। যেহেতু এ মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী; তাই এ মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহঃ)

 

আলহামদুলিল্লাহ, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও এই ভাগ্যের রজনী আমাদেরই কাছে এসেছে। গত শুক্রবার দেশে বিদেশে প্রতিটি মসজিদের খতিব বা ইমামগণ বয়ান ও খুতবার মাধ্যমে এই মহিমান্বিত, দিনটির ফজিলত পূর্ণ ও বরকতময় বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। আমাদের বৃটেনের ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরের বড় দুটি মসজিদ শাহজালাল মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মাওলানা কাজী ফয়জুর রহমান সাহেব ও জালালিয়া মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মাওলানা আব্দুল মুক্তাদির সাহেব সহ অন্যান্য মসজিদগুলোর এমাম ও খতীবগন মুক্তির রজনী পবিত্র লাইলাতুল বরাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

 

শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয় – যা যা করা উচিতঃ

(ক) নফল নামাজ

১. তাহিয়্যাতুল অজু, ২. দুখুলিল মাসজিদ, ৩. আওয়াবীন, ৪. তাহাজ্জুদ, ৫. ছলাতুত তাসবীহ ৬. তাওবার নামাজ, ৭. সালাতুল হাজাত, ৮. সলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।

(খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা;

(গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা;

(ঘ) কোরআন শরীফ- যেমনঃ সুরা দুখান ও অন্যান্য ফজিলতের সূরা সমূহ তিলাওয়াত করা;

(ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; (চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা;

(ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা;

(জ) কবর জিয়ারত করা;

(ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।

 

যা যা করা উচিত নয়ঃ

(১) আতশবাজি ও পটকা না ফোটানো;

(২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা না করা;

(৩) আনন্দ-উল্লাস না করা;

(৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ না করা;

(৫) অন্য কারও ইবাদত বা ঘুমের বিঘœ না ঘটানো;

(৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়া-দাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট না করে ইবাদত-বন্দেগির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।

 

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?” আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খÐ, পৃষ্ঠাঃ ৩৮২)।

 

হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া–বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজিঃ ৭৩৯)।

 

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহঃ ১৩৮৪)।

 

এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩/১৪/১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এ দিনের রোজা আইয়ামেবিদের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠাঃ ১৫১)।

 

এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর একদিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মাহাতুল মুমিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।

 

মহানবী (সা.) রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের রাতগুলোতে বিশেষভাবে দোয়া করতেন। আমাদেরও দোয়া করা উচিৎ হে আল্লাহ! আমার জন্য রমজান যেন মোবারক হয়, আমাকে সুস্থ রাখুন, আমি যেনো রমজানের রোজা রাখতে পারি।

 

তাই আসুন, পবিত্র শাবান মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে রমজানের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করি আর ব্যক্তিগত ব্যস্ততার গুলোকে গুটিয়ে নিয়ে আসি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

 

পরিশেষে একে অন্যের জন্য দোয়া করবেন দোয়াই হচ্ছে একমাত্র ভরসা। এ রাতের প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ তাওবাকারীকে ক্ষমা করে দেবেন, অভাবীকে রিজিক দেবেন, বিপদগ্রস্থকে বিপদ মুক্ত করবেন। আসুন মহানবী রাসুল (সাঃ) নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা পীর মাশায়েখগণ এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই অনুসরণ করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যথাযথভাবে শবে বরাত পালন করার তৌফিক দান করুন। এই কামনা সহ আমরা দোয়া করি, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন প্রতিটি মানুষের উপর খাস রহমত ও বরকত দান সহ মৃত্যুবরণকারী সবাইকে জান্নাতবাসী করেন, সকল অসুস্থ রোগীদের শিফা দান করেন। উচ্চারণ ঃ“আল্লাহুম্মা, রাব্বান নাস! আযহিবিল বা’স। ওয়াশফি, আনতাশ শাফি। লা শিফাআ ইল্লা শিফা-উক, শিফা-আ’ লা ইউগাদিরু সাকামা।” অর্থঃ ‘হে মানুষের প্রতিপালক! এ রোগ দূর কর এবং আরোগ্য দান কর, তুমিই আরোগ্য দানকারী। তোমার আরোগ্য ব্যতীত কোন আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য, যা বাকী রাখে না কোনো রোগ।’ (বুখারি, মিশকাত) আমিন।

 

প্রকৃত ইসলামের আলোয় জাগ্রত হোক মানবতা।

মোহাম্মদ মকিস মনসুর।


লেখক ও সাংবাদিক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে ওয়েলস ডিভিশন, সাবেক সেক্রেটারি, কার্ডিফ শাহজালাল মস্ক এন্ড ইসলামিক কালচারাল সেন্টার ইন ইউকে।

 

(সুরমামেইল/এফএ)


সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com