সিলেট ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:২৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৫
সুরমা মেইলঃ অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, যাতে থাকবে মিসাইলসহ সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্র। সঙ্গে থাকবে মাল্টিরোল গান, একটি সিঙ্গেল ব্যারেল গান, ট্রিপল টুবার টর্পেডো লঞ্চার, নেভিগেশন রাডার, এয়ার অ্যান্ড সারফেস সার্চ রাডার ও ট্র্যাকিং রাডার। এই জাহাজ থেকে শনাক্ত করা যাবে শত্রুপক্ষের সাবমেরিন, অপ্রতিরোধ্য আক্রমণও করা যাবে পানির নিচে ডুবে থাকা শত্রুপক্ষের সাবমেরিনেও। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের এত এত শক্তি নিয়ে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ হচ্ছে এখন বাংলাদেশে, একসময় লোকসানে বন্ধ হতে যাওয়া খুলনা শিপইয়ার্ডে। এলপিসি (লার্জ প্যাট্রল ক্রাফট) নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত এমন দুটি বড় যুদ্ধজাহাজ নির্মাণকাজের শুভসূচনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে শুরু করবেন আজ রবিবার। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে আধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণকারী দেশের কাতারে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ।
যে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড এই যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করবে, সেই প্রতিষ্ঠানটি নিজেই যুদ্ধাহত পঙ্গুর মতো অব্যাহত লোকসানে নুয়ে পড়েছিল বছরের পর বছর। নিজের ব্যয় বহনের ভার বইতে না পেরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল প্রতিষ্ঠানটির। ১৯৯৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাহাজ নির্মাণের এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে না দিয়ে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। তাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় শক্ত ভিত পায় প্রতিষ্ঠানটি, লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখে। ছোট ছোট যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ অব্যাহত থাকবে। বড় যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে এবার আরো বড় মাইলফলক সৃষ্টি করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এত দিন চীন থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এ ধরনের জাহাজ কেনা হতো। দেশেই তৈরি হওয়ায় এখন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, বাড়বে আত্মনির্ভরশীলতা।
খুলনা শিপইয়ার্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, বড় এলপিসি নির্মাণে গত বছরের ৩০ জুন নৌবাহিনীর সঙ্গে খুলনা শিপইয়ার্ড চুক্তি করেছে। তাতে প্রতিটি যুদ্ধজাহাজের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। চার মিটার গভীরতাসম্পন্ন এই যুদ্ধজাহাজের দৈর্ঘ্য হবে ৬৪ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ ৯ মিটার। সমুদ্রপথে ঘণ্টায় ২৫ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলতে পারবে জাহাজটি। একসঙ্গে ৭০ জন থাকতে পারবে জাহাজে। চীনের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় আজ থেকে দুই বছরের মধ্যে এ জাহাজ নির্মাণ শেষ হবে। খুলনা শিপইয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমোডর এস ইরশাদ আহমেদ বলেন, দেশের মাটিতে এমন অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ হলে আমদানি নির্ভরতা কমবে, দেশের সক্ষমতা প্রমাণিত হবে। এগুলো এলপিসি হলেও এতে করভেটের (আরো বড় আকৃতির যুদ্ধজাহাজ) অধিকাংশ সুবিধা থাকবে। থাকবে স্বয়ংক্রিয় মিসাইলসহ অত্যাধুনিক সব যুদ্ধাস্ত্র। আরো থাকবে একটি মাল্টিরোল গান, একটি সিঙ্গেল ব্যারেল গান, দুটি ট্রিপল টুবার টর্পেডো লঞ্চার, দুটি নেভিগেশন রাডার, একটি এয়ার অ্যান্ড সারফেস সার্চ রাডার ও একটি ট্রাকিং রাডার।
ইরশাদ আহমেদ বলেন, নির্মিতব্য এলপিসি শত্রুপক্ষের সাবমেরিন শনাক্ত করে তাতে আক্রমণ করতে পারবে। এটি দিয়ে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় টহলও দেওয়া যাবে। জাহাজের পেট, ইঞ্জিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে। শিপইয়ার্ডের ২৫০ জন শ্রমিক ও প্রকৌশলী জাহাজ নির্মাণে কাজ করবেন। চীন এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছরের শুরুতে নৌবাহিনীর জন্য দুটি এলপিসি কেনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখনই বিদেশ থেকে না কিনে নিজেরাই নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় খুলনা শিপইয়ার্ড। প্রতিষ্ঠানটি অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রসংবলিত জাহাজ নির্মাণ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে তখন অনেকের মধ্যেই সংশয় দেখা দেয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও নৌবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সুপারিশে এই বিরল সুযোগ পায় খুলনা শিপইয়ার্ড। এর আগে, ২০১৩ সালে খুলনা শিপইয়ার্ড পাঁচটি ছোট যুদ্ধজাহাজ (প্যাট্রল ক্রাফট) নির্মাণ করে। তখনই যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ শিল্পে নতুন অধ্যায় শুরু বাংলাদেশের। প্যাট্রল ক্রাফট নির্মাণের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার বড় আকারের অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের কাজ শুরু করছে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৫৭ সালের ২৩ নভেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করে খুলনা শিপইয়ার্ড। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন জার্মান ও বিট্রিশ প্রযুক্তিবিদরা। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (ইপিআইডিসি) এর দায়িত্ব নেয়। দেশ স্বাধীনের পর খুলনা শিপইয়ার্ডের অভিভাবকত্ব পায় বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিআইডিসি)। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (বিএসইসি) গঠিত হয়। তখন বিএসইসির আওতায় চলে খুলনা শিপইয়ার্ড। এত দিন লাভজনকভাবে চলা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯০ সালের দিকে এসে লোকসানে পড়ে, আস্তে আস্তে রুগ্ণ শিল্পের তালিকায় জায়গা হয়, বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। নৌবাহিনী যখন দায়িত্ব নেয়, তখন প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছিল ৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সেই দায় মিটে গেছে, এখন রয়েছে মুনাফায়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির টার্নওভার (বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ) ছিল ১৬ কোটি টাকা, যা এখন ১৭১ কোটি টাকা।
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি