সিলেট ২৪শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০১৬
সুরমা মেইল নিউজ : আজ ৩০ জুন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস আজ। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিন এটি। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শাসন, শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে পরাধীন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সৃষ্টি হয় ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ।
১৮৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত এ বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিহার, উড়িষ্যা এবং বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের তীব্রতা ও ভয়াবহতায় ইংরেজ শাসনের ভীত কেঁপে উঠেছিল। লর্ড ডালহৌসি কতৃক মার্শাল ল’ জারি করেও এ বিদ্রোহ দমান করা যায়নি।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ভাগনদিহিতে চারশ গ্রামের দশ হাজার সাঁওতাল এক সমাবেশে উপস্থিত হয়। সিদু সমাবেশে ইংরেজ ও জমিদার মহাজন কর্তৃক তাদের ওপর নির্মম নিপীড়নের করুণ কাহিনি তুলে ধরে বক্তব্য দেন।সমগ্র জনসভা এ সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণিকে উৎখাত করে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয় তারা সমাবেশ থেকে। এই সমাবেশ থেকেই ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করা হয়। দারোগা ও জমিদারদের নিকট ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দাবি করা হয়।এক পর্যায়ে প্রায় ৫০ হাজার সাঁওতালের এক বিশাল মিছিল বড়লাটের কাছে অভিযোগ পেশ করার উদ্দেশ্যে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য ধর্মের শোষিত, নিপীড়িত মানুষ।
সাঁওতালদের এ সমবেত অভিযাত্রার কথা শুনে শোষক শ্রেণির মহাজন জমিদাররা ভীত হয়ে পড়ে। তারা দারোগা মহেশলাল দত্তকে ঘুষ দিয়ে সিদু, কানুকে গ্রেফতার করার জন্য প্ররোচিত করে। দারোগা সিদু ও কানুকে চুরি ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার করতে গেলে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বাঁধা দেয়।দারোগা জোরপূর্বক সিদু, কানুকে গ্রেফতার করতে চাইলে বিদ্রোহীরা সেখানেই মহেশলাল দত্ত, মহাজন মানিক মুদিসহ ১৯ জনকে হত্যা করে। কানু ঘোষণা দেন, ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, এখন আর কোনো হাকিম নেই, ইংরেজ নেই, সরকার নেই। সাঁওতালদের রাজত্ব এসে গেছে।’
বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা বহু থানা, ইংরেজ সৈন্যদের ঘাটি, নীলকরদের কুঠি আক্রমণ ও ভস্মীভূত করে। সমগ্র বিহার, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতালদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সরকার এ আকস্মিক বিদ্রোহের প্রচণ্ডতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। অবশেষে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে ১৫ হাজার সৈন্য, অশ্বারোহী বাহিনী, কামান বাহিনী ও হস্তী বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালানো হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড বর্বরতায় উন্মত্ত হাতি ছেড়ে দেয়া হয় সাঁওতাল নারী ও শিশুদের মধ্যে।কামান ও বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এভাবে ৩০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে ইংরেজ বাহিনী। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ ও ভৈরব নিহত হন। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ বাহিনী সিদুকে ধরে ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশ কর্তৃক ধৃত হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু, কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের চিরদিনের প্রেরণার উৎস। এ সংগ্রামে পরাজয় ছিল কিন্তু আপোষ ছিল না। বিদ্রোহীরা নির্ভয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি প্রেরণা যুগিয়েছে ভারতবর্ষের পরবর্তী সকল স্বাধীকার আন্দোলনে। ফাঁসির মঞ্চে কানুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল, ‘আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’। তার এ কথা সত্য হয়েছে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেনদের আত্মত্যাগে। সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রমাণ করে দিয়েছে মুক্তির সংগ্রাম কোনো দিন শেষ হয়ে যায় না। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম চলবে ততদিন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের পর কেটে গেছে ১৬০ বছর। মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়ালেও বদলায়নি সাঁওতালদের ভাগ্য। তারা থেকে গেছে শোষিতের কাতারে। কালে কালে শুধু বদলেছে শোষকের পরিচয়। আজও অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, জাতিগত বৈষম্য, হয়রানি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। তাদের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটাপন্ন, ভাষা বিপন্ন। তাদের উন্নয়নের জন্য অদ্যাবধি তেমন আন্তরিক ও জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তারা কী ধরনের উন্নয়ন চায় সে ব্যাপারে তাদের অভিমত শোনার প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি কেউ। নিজের দেশেই, এই স্বাধীন মাটিতেই তারা চরম অবহেলার শিকার হয়ে আজো বেঁচে আছে।
অধিপতিশীল জ্ঞানকাঠামোয় সিদু, কানুদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সেভাবে উচ্চারিত হয় না। তাতে কি আসে যায়, জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যু সেখানে শেষ কথা নয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদদের লাল সালাম।
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি