উপমহাদেশের লাল বর্ণের দুর্গা পূজিত হচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও-এ

প্রকাশিত: ৩:২৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০১৬

উপমহাদেশের লাল বর্ণের দুর্গা পূজিত হচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও-এ

panch-gaon

সুনির্মল সেন :: বৃহত্তর সিলেটের ‘ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও’-এ প্রতি বছরের ন্যায় এবার সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্ভীরা ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশের মধ্যদিয়ে লালবর্ণ ভগবতী, মা দুর্গাপূজা উৎসব পালন করছে। এখানে জাগ্রত দেবী, ভগবতীর আর্শীবাদ নিতে দীর্ঘ পথ জুড়ে হাজার হাজার লোকের ভীড় জমে উঠেছে।

ভক্তদের বিশ্বাস জাগ্রত অবস্থায় লালবর্ণে পূজো নিতে হাজির হয়েছেন দেবী, মা দুর্গা। তাঁর কাছে কায়মনোচিত্তে কোনো কিছু মানত করলে আশাপূর্ণ হয়।

বাংলাদেশের সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও গ্রামে প্রায় আড়াইশত বছর যাবত উপমহাদেশের একমাত্র লাল রক্তবর্ণ (লাল বর্ণের) দুর্গা পূজিত হয়ে আসছেন। পারিবারিক এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ ও ভক্তকূলের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে পূজাস্থল।

দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অসংখ্যলোক লালবর্ণের আদ্যাশক্তি মা দুর্গাকে এক নজর দেখার জন্য পাঁচগাঁওয়ে সমবেত হচ্ছেন। এতে সকল মানুষের আনন্দের সীমা নেই। অনেক ভক্তরা আবার বিভিন্ন মানত নিয়ে দেবীর কাছে এসেছেন এই পূজা মন্ডপে।

গত শনিবার মহাসপ্তমীর বিহিতপূজায় দুপুর থেকে পাঠা বলি শুরু হয়। আজ মহানবমী বিহিতপূজার তিথিতেও পাঠাসহ মহিষ বলি দেয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্ভীদের এ শারদীয় দুর্গোৎসব পরিণত হয়েছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আদিবাসীসহ সকল স্তরের মানুষের মিলন মেলায়।

ভগবতী মা দুর্গা সকল অন্ধ্যকার আর সকল অশুভশক্তিকে পরাজিত করে এ প্রার্থিব জগতে ছড়িয়ে দিবেন মানুষের ভ্রাতৃত্ব এবং মানবতাবোধ এমনটাই রক্ত বর্ণের মা দুর্গার কাছে প্রত্যাশা ভক্তকূলসহ অনুরাগীদের।

প্রসঙ্গত, প্রায় তিনশত বছর আগে সর্বানন্দ দাস তৎকালীন সরকারের অধীনে মুন্সি পদবীতে চাকুরী করতেন। তাঁর কর্মস্থল ছিলো ভারতের আসামের শিব সাগর জেলায়। সেখানে চাকুরীতে থাকা অবস্থায় একদিন শারদীয় দুগোৎসবের সময় তিনি কামাখ্যা ধামে কুমারীপূজা করবার জন্য মনস্থির করেন এবং তাঁর বাড়িতে যথাবিহিত পূজা সম্পন্ন করবার জন্য তাঁর স্ত্রী ও কর্মচারীদের নির্দেশ প্রদান করেন।

জনশ্রুতি রয়েছে, সর্বানন্দ দাস কামাখ্যা ধামে উপস্থিত থেকে কুমারীপূজা করার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন। মন্দিরের সেবায়েতের সহায়তায় তিনি পঞ্চম বছর বয়সের কুমারী নির্বাচন করেন। মহাঅষ্টমী তিথিতে কুমারীকে আসনে যথাবিহিত উপবেশন করে ষোড়শোপচারে স্বয়ং ভগবতী জ্ঞানে পূজা চলিতে লাগিলো। প্রায় ছয় ঘন্টা যাবত পূজা অনুষ্টিত হইলো এবং কুমারীও প্রস্তরবৎ সুদীর্ঘ ছয় ঘন্টা ব্যাপী আসনে বসা ছিলেন। পূজা শেষে মা দুর্গাকে প্রণাম করার পর সর্বানন্দ দাস এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেন, কুমারীর গাঁয়ের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারন করেছে। এই দৃশ্য দেখার পর সর্বানন্দ দাস আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘মা’ আমার পূজা সুপ্রসন্ন হয়েছে কী? উত্তরে ভগবতী মা দুর্গা বলেন, ‘হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এই বর্ণে তোর গ্রামের বাড়ি পাঁচগাঁও-এর পূজা মন্ডপে আবির্ভূত হয়েছিলাম। এখন হতে তুই ভগবতীকে লালবর্ণে পূজা করিবে।’

তখন সর্বানন্দ মাকে প্রশ্ন করেছিলেন তার প্রমাণ কি? উত্তরে কুমারী দেবী বলেন, ‘তোর দুর্গা মন্ডপের বেড়ার উপর হাতের ছাপ রেখে এসেছি। ভগবতী আবার বলেন, তোর পূজায় আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি, তুই আমার কাছে বর প্রার্থনা কর।’

সর্বানন্দ দাস আবার বলেন, ভগবতীর শ্রী পাদপদ্ম পাওয়াই আমার একমাত্র কামনা। তবুও কুমারী দেবী বর চাওয়ার জন্য পীড়া-পীড়ি করতে লাগলেন। তখন বাধ্য হয়ে সর্বানন্দ দাস ভগবতীকে বলেন, মা তুমি যদি একান্তই বর দিতে চাও, তবে আমি এই বরই প্রার্থনা করি যে, আমার স্থাপিত পাঁচগাঁও-এর দুর্গামন্ডপে তুমি স্থায়ী ভাবে অধিষ্টিতা থাকবে। ভগবতী তথা¯ুÍ বলে তাঁর নিজের মাথায় পরিহিত স্বর্ণের সিঁথি খুলে ভক্ত সর্বানন্দের হাতে দেন এবং প্রতি বছর মহা¯œানের সময় এই সিঁথিদ্বারা ¯œান করাবার নির্দেশ দেন। অতঃপর সর্বানন্দ মাকে প্রণাম করে কামাখ্যা ধাম ত্যাগ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। এখানে আসার পর সর্বানন্দ দাস দুর্গা মন্ডপে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখলেন যে, সত্যই বেড়ার উপর দেবীর হাতের ছাপ দেখা যাচ্ছে।

পরবর্তি বছর পাঁচগাঁও-এর নিজ বাড়িতে সর্বানন্দ দাস শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করতে শুরু করেন। ভারতের কামাখ্যা ধামে দেবীর আদেশ অনুযায়ী মাতৃমূর্তিকে কুমারীর গায়ের সেই লালবর্ণের সহিত সাদৃশ্য রেখে লালবর্ণে রঞ্জিত করান।

ভগবতী মা দুর্গার ধ্যানে উল্লেখ আছে, তদীয়া গায়ের বর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায়। কিন্তু তৎপরবর্তিতে লালবর্ণ দেয়ায় গ্রামবাসী, সর্বানন্দের আত্মীয়-স্বজন, গুরু, পুরোহিত এই দৃশ্য দেখে উহা শাস্ত্র বিরুদ্ধ বলে সকলেই এক বাক্যে অভিমত পোষন করেন এবং সর্বানন্দ দাসকে এতোদৃশ্য অশাস্ত্রীয় কাজ হতে নিজেকে বিরত থাকার জন্য তারা অনুরোধ করেন। তখন সর্বানন্দ তার কামাখ্যা ধামের চাক্ষুস অভিজ্ঞতার কথা ব্যাক্ত করেন। ইহাকে তারা নিছক মনগড়া ও পাগলামী বলে সকলে সিদ্ধান্ত নেন। গুরু, পুরোহিত, আত্মীয়বর্গ কেহই পূজায় যোগদান করবেন না বলে সর্বানন্দকে জানিয়ে দেন।

সেই বছর মহাষষ্টি বিহিত পূজার দিন রাত্রি পর্যন্ত কেহ পূজা মন্ডপে আসেননি। পুরোহিতের অভাবে দেবীর বোধন সে সময় সম্পন্ন হয়নি। সর্বানন্দ পাগলের ন্যায় মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলেন। নিশা অবসানের সময় সমাগত প্রায়, এমন সময় এক আলৌকিক কান্ড ঘটে যায় মন্ডপে। গুরু, পুরোহিত, আত্মীয়বর্গ এবং গ্রামবাসী সকলে পূজা মন্ডপে এসে জানালেন যে, ভগবতী লালবর্ণে পূজিতা হবেন বলে তাঁরা স্বপ্নে আদেশ পেয়েছেন। ভোর সমাগত ঢাক-ঢোল, শঙ্খ, ঘন্টা ও উলু ধ্বনীর শব্দে চারিদিক মুখরিত। এরপর মহাসপ্তমীর বিহিত পূজা মহাসমারোহে আরম্ভ হইলো।

পরবর্তি বছর হতে সর্বানন্দের ওপর জ্ঞাতি বাড়িতেও ভগবতী এই লালবর্ণে পূজিতা হতে লাগলেন। বর্তমানে একসাত্র সর্বানন্দ দাসের দুর্গা মন্ডপেই ভগবতী মা দুর্গা পূজিতা হচ্ছেন এবং এই লালবর্ণেই পূজিতা হচ্ছেন। উহাই আদ্যাশক্তি, মহামায়া, মহাশক্তি, ভগবতী মা দুর্গার অভূত বিকাশের বিশেষ দিক।

প্রতিবেদক : সুনির্মল সেন, সুরমা মেইল নিউজ ইনচার্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com