কাদের-চুন্নুকে বহিষ্কার করে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশনের

প্রকাশিত: ৫:০৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪

কাদের-চুন্নুকে বহিষ্কার করে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশনের

সুরমামেইল ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলে ভরাডুবির পরে সৃষ্ট জটিলতাকে কেন্দ্র করে অবশেষে নতুনভাবে জাতীয় পার্টি গঠনের কথা জানালেন দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রওশন এরশাদ।

 

তিনি বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন৷ একইসঙ্গে নিজে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন ও তার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদকে দলের মহাসচিবের পদে বহাল করেছেন৷

 

জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন জানান, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিভিন্ন সময়ে জাপার যেসব নেতাদের বিভিন্ন পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি বা বহিষ্কার করেছেন, তাদের স্বপদে বহাল করা হবে৷ খুব শিগগির দলের দশম কাউন্সিল আয়োজন করা হবে৷

 

রবিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের বাসভবনে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন।

 

লিখিত বক্তব্যে রওশন এরশাদ বলেন, ‘দলের সংকট নিরসনে পার্টির নেতাকর্মীদের অনুরোধে এবং পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১ ধারায় বর্ণিত ক্ষমতাবলে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে জি এম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম। নেতা-কর্মীদের অনুরোধে আমি পার্টির চেয়াম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত আমি কাজী মো. মামুনুর রশিদকে মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করলাম। তিনি সার্বিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন৷’

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক অঙ্গণে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেয় জাপা৷ নির্বাচনে যাওয়া, না যাওয়ার প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার গোপন বৈঠকে দলের ভেতরে টানাপড়েন তৈরি করেন দলের শীর্ষ তিন নেতা৷ নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক দুর্বলতা এতই প্রকট হয়ে পড়ে যে ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পায়নি দল। নির্বাচনের পরে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু।

 

নির্বাচনের পরে জাতীয় পার্টিতে ‘ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে’ উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেন, ‘দ্বাদশ নির্বাচনের পূর্বে পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বক্তব্য ও বিবৃতি এবং দ্বাদশ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের ভূমিকা পার্টিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাতীয় নিবার্চনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৭টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদান করে ২৬টি আসনে সমঝোতা করা এবং আসন সমঝোতার পরেও জন সম্মুখে অস্বীকার করে- দেশবাসী এবং পার্টির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পার্টিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’

 

এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে ২৬টি আসনে সমঝোতা করেছিলো, তার মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয়লাভ করেন৷ সমঝোতা হওয়া আসনগুলোর মধ্যে চারজন প্রার্থী জামানত হারান৷ সমঝোতা হওয়া আসনগুলোর বাইরে থাকা প্রার্থীরা বিপুল ভোটে হেরে জামানত হারান।

 

সমঝোতার বাইরে থাকা আসনগুলোর প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেন, ‘২৬টি আসন সমঝোতার পর বাকি আসনের প্রার্থীদের রাজনৈতিকভাবে জনগণের বিরূপ সমলোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব তাদের কোনো খোঁজ খবর না নেয়ার ফলে ভোটের মাঠে পার্টি চরম ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।’

 

নির্বাচনের পরে হেরে যাওয়া জাপা প্রার্থীদের বড় অংশ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন৷ গত ১০ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন৷ সমাবেশে জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যর্থতার অভিযোগ এনে দুজনের পদত্যাগ দাবি করেন বিক্ষুব্ধ নেতাদের একাংশ৷

 

পরে ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক সভায় জাপার বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা জাপার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন৷ নির্বাচনে ভরাডুবির নানা কারণের পাশাপাশি দলের তৃণমূলকে ধসিয়ে দেওয়ায় শীর্ষ নেতাদের দায় দেন তারা৷ তখন জাপার দায়িত্বশীল নেতাদের বরাতে জানা যায়, বিক্ষুব্ধ অংশের নেতাদের মদদ দিচ্ছেন জাপা থেকে নানা সময়ে বহিষ্কৃত ও অব্যাহতি পাওয়া নেতারা৷ তারা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের তোড়জোড় শুরু করেন৷

 

এসময় দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন জি এম কাদের৷ তিনি দলের প্রভাবশালী নেতা ও কো চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকে দলের পদ পদবী থেকে অব্যাহতি দেন৷ এতে জাপায় অভ্যন্তরীণ সংকট আরও বেশি দৃশ্যমান হয়৷

 

গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির কয়েকজন নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেন৷ রবিবার রওশন এরশাদের বাসভবনে সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ইয়াহিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সভায় বক্তব্য পর্বে তারা জাপার সংকট নিরসনে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান৷

 

রোববারের মতবিনিময় সভায় জাপায় বিক্ষোভের যৌক্তিকতা নিয়েও কথা বলেন রওশন এরশাদ। গত ২২ জানুয়ারি জাপায় ঐক্য ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে চিঠি দেন রওশন এরশাদ৷ রওশন এরশাদ অভিযোগ করেন, তার সেই আহ্বান আমলে নেননি তারা৷ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ায় পার্টির নেতাকর্মীরা তার প্রতিবাদ করার অধিকার রাখেন। এই প্রতিবাদী নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা কিংবা সান্তনা প্রদান না করে ক্রমাগত বহিষ্কার ও অব্যাহতির মাধ্যমে পার্টির অস্তিত্ব নষ্ট করা হয়েছে।’

 

রওশন এরশাদের সঙ্গে এদিন উপস্থিত ছিলেন তার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ, জাপা থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান আমানত হোসেন, ইয়াহিয়া চৌধুরী। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি ছেড়ে যাওয়া অনেক নেতাকর্মী মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হন।

 

তাদের মধ্যে রয়েছেন, জাপার সাবেক এমপি সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, গোলাম সারোয়ার মিলন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় ছাত্রসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল হাফিজ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরুসহ আরও অনেকে৷

 

শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, আমরা কেউ জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করতে চাই না৷ আমরা আজকে থেকে রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাই৷ ৭ তারিখের নির্বাচনের পরে দলে যে আবর্জনা তৈরি হয়েছে, আমরা সেই আবর্জনা আপনার নেতৃত্বে পরিষ্কার করতে চাই৷

 

ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, ৭ জানুয়ারির পরে দলে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা ঠেকাতে হলে ম্যাডাম আপনাকে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে।

 

(সুরমামেইল/এফএ)


সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com