সিলেট ১৬ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:২৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০১৬
সুরমা মেইল নিউজ : হামলাকারী জঙ্গিদের পারিবারিক পরিচয় উদ্ঘাটিত হলেও তাদের আদৌ আইএস বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল কিনা কিংবা তারা দেশি কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিনা, সে ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ তৎপরতার পরও এগুচ্ছে না গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের চাঞ্চল্যকর জঙ্গি হানার তদন্ত। বরং নানা প্রতিবন্ধকতা ও বিভ্রান্তির কারণে তদন্তকারী দল তাদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে একই আবর্তে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে হামলাকারী জঙ্গিদের পারিবারিক পরিচয় উদঘাটিত হলেও তাদের আদৌ আইএস বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল কিনা কিংবা তারা দেশি কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য- সে ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে।
এমনকি এ হত্যা মিশনে কতজন জঙ্গি অংশ নিয়েছিল; তাদের সবাই কি মারা পড়েছে; নাকি জিম্মি অতিথিদের সঙ্গে তাদেরও দু-একজন নির্বিঘ্নে বেরিয়ে গেছে সে ব্যাপারেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য তদন্তকারীরা এখনো জোগাড় করতে পারেনি। এ ধরনের বৃহৎ পরিসরের হত্যা মিশনে সাধারণত কিলারদের ‘ব্যাকআপ টিম’ থাকলেও এ ঘটনায় তা ছিল কিনা তা-ও এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি তদন্তকারীরা। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তিন যুবককে সন্দেহ করা হলেও গোয়েন্দাদের পক্ষে গত ১১ দিনেও তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য সংগ্রহ করাই সম্ভব হয়নি।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এ বাস্তবতা স্বীকার করলেও তদন্তে অগ্রগতির পথে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলোর কথা জানাতে চাননি। স্পর্শকাতর মামলা হওয়ায় হামলাকারী সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর প্রতিটি তথ্য দফায় দফায় ক্রসচেক করে জঙ্গি সংগঠনের মূল লিংক খোঁজা হচ্ছে বলে দাবি করেন তারা। জঙ্গিদের কেউ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি বলেও নানা যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন তদন্তে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অথচ হামলাকারীদের সংখ্যা নিয়ে জিম্মি দশা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে তদন্তকারীদের বক্তব্যের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। হলি আর্টিজানের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অতিথি জানান, তারা অস্ত্রধারী অন্তত ৭ জঙ্গিকে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতে দেখেছেন। যারা সবাই গুলি, বোমা বিস্ফোরণ ও হত্যাযজ্ঞে সক্রিয় অংশ নেয়।
অথচ ঘটনার পরদিন সকালে সেনা নেতৃত্বাধীন ‘থান্ডারবোল্ট’ অপারেশন পরিচালনার পর ঘটনাস্থল থেকে ৬ জনের লাশ উদ্ধার করে এদের
জঙ্গি বলে চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে একজন হোটেলের ‘সেফ’ বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোরালো দাবি করে। পরবর্তীতে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এদের ৫ জন জঙ্গি বলে প্রমাণিত হয়।
এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চয়তা মেলে, হামলাকারী দলের অপর অন্তত দুই সদস্য পালিয়ে গেছে; অথবা পরিচয় গোপন করে তাদের আড়াল করা হয়েছে। অথচ তদন্তকারী দল এখনো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য তদন্ত নথিতে যোগ করতে পারেনি।
এদিকে নিহত জঙ্গিরা পরিবার থেকে অন্তর্ধানের পর এবং হামলার আগ পর্যন্ত কোথায়, কার আশ্রয়ে ছিল, কারা তাদের জঙ্গি দলে টানল, কোথায় কীভাবে তাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়া হলো-এর কোনো তথ্যই এখনো জোগাড় করতে পারেনি গোয়েন্দারা।
এদিকে কূটনৈতিক এলাকার কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে জঙ্গিরা কীভাবে, কোন পথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও শক্তিশালী বিস্ফোরক নিয়ে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ঢুকল গোয়েন্দারা এখনো তার কিছুই জানতে পারেনি। এমনকি পুরো গুলশান এলাকায় পুলিশ ও গুলশান সোসাইটির উদ্যোগে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানো থাকলেও সেগুলোর ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করেও জঙ্গিদের গতিবিধির কিছুই শনাক্ত করা যায়নি।
হলি আর্টিজানের একজন নিরাপত্তাকর্মী জঙ্গিদের একটি মাইক্রোবাসে নামিয়ে দেয়া হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের জানালেও তারা এখনো সেটি খুঁজে বের করতে পারেনি। গুলশান এলাকার সিসি ক্যামেরাগুলোতে ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা থাকলেও এখনো জঙ্গিদের বহনকারী বাহনটি শনাক্ত হয়নি।
বিষয়টি স্বীকার করে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের (সিটি) ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, গুলশানের অধিকাংশ সড়কের মোড়ে সিসি ক্যামেরা নেই। এ কারণে জঙ্গিরা কোন পথ দিয়ে গুলশানে ঢুকেছে তার ছক মেলাতে পারছেন না তারা। এ ছাড়া রেস্টুরেন্টে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেগুলোর কোনো ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে মেট্রোরেল প্রকল্পের ছয় সমীক্ষকসহ সাত জাপানি, ইতালীয় ৯ ব্যবসায়ী ও ভারতীয় নাগরিক তারাশি জৈন কি স্রেফ ঘটনাক্রমে একই সময় হলি আর্টিজানে খাবার খেতে এসেছিলেন নাকি তাদেরও কৌশলে সেখানে একত্রিত করা হয়েছিল সে রহস্য এখনো গোয়েন্দাদের কাছে অধরা।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ধরনের মামলা তদন্তে তাড়াহুড়ো করার সুযোগ নেই। সবকিছু সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
তবে ধীর গতিতে হলেও তদন্ত এগোচ্ছে কিনা তা জানতে চাইলে দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ও বিভ্রান্তিতে তদন্ত এখন অনেকটা এক জায়গাতেই আটকে আছে।
তার দাবি, নিহত যে পাঁচ জঙ্গির পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের তিনজন প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাই অভিভাবকদের সহজেই জিজ্ঞাসাবাদ করা যাচ্ছে না। একই কারণে হামলাকারীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিও দূর করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
হলি আর্টিজানের নিকটবর্তী অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা কোরিয়ান নাগরিক ডি কে হোয়াংয়ের গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় যে তথ্য পাওয়া যায়, তার সঙ্গে অনেকের দাবির কোনো মিল নেই বলে মন্তব্য করেন তদন্ত দলের অপর এক সদস্য।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, হলি আর্টিজানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময় ধূর্ত জঙ্গিরা অস্ত্রের মুখে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীসহ বেশ কজন বাংলাদেশি অতিথিকে তাদের সহায়তার কাজে লাগায়। এমনকি থান্ডারবোল্ট অপারেশন চলাকালে তাদের হাতে গুলিভর্তি আগ্নেয়াস্ত্রও তুলে দেয়া হয়েছিল। যা অন্যান্য জিম্মিদের পাশাপাশি এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের বিভ্রান্ত করে। তাই তারাও জঙ্গিদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারছে না। আর এ জট খোলা এখন তদন্তকারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া জিম্মি দশা থেকে উদ্ধার হওয়া দেশি-বিদেশি ব্যক্তিরা আতঙ্কাবস্থা কাটিয়ে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। তাই তারা গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। আবার বেশ কয়েকজন বিদেশি নৃশংস এ ঘটনার পর আতঙ্কিত হয়ে দেশ ছেড়ে গেছেন। তাই সব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে হামলাকারী জঙ্গিরা দেশীয় হলেও তাদের সঙ্গে আইএস কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর যোগসাজশ আছে কিনা সে ব্যাপারেও তদন্তকারী দল নিশ্চিত হতে পারছে না। কারণ আইএসের কর্মকা- ও তাদের হামলার ধরনের সঙ্গে গুলশান কিলিংসহ সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলা ও হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এমনকি তাদের মূল টার্গেটও অনেকটা একই। তাই এ নিয়ে গোয়েন্দারা পুরোপুরি গোলক ধাঁধায় রয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা ঠিক যে বাংলাদেশে এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সমন্বয় কোথা থেকে এবং কীভাবে হয় তা এখনো স্পষ্ট নয়। এর কোনো একক সমন্বয়কারী আছেন কিনা তাও এখনো অজানা।
এদিকে অপরাধ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সরকার ও দেশের স্বার্থেই তদন্তকারীরা ধীর গতিতে এবং বেশকিছুটা রাখঢাক করেই তদন্ত করছে। অথবা চাঞ্চল্যকর এ মামলায় উন্নত দেশগুলোর সহায়তা নেয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সিঙ্গাপুর থেকে প্রযুক্তি সহায়তা নেয়ার কথা বলেছেন। তবে এসব দেশ কবে কীভাবে এ ব্যাপারে সহায়তা দেবে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পর্কের বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে আসলেও দেশের স্বার্থেই তদন্তকারীদের তা গোপন রাখতে হবে। আর এ কারণেই বেশকিছু তথ্য অনুদঘাটিতই রয়ে যাবে। এতে নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।
উল্লেখ্য, স্প্যানিস এ রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য ২৪ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত। ঢাকার মহানগর হাকিম সি্নগ্ধা রানী চক্রবর্তী ৬ জুলাই এ দিন নির্ধারণ করেন।
সুত্র : যায়যায় দিন।
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি