যে ভাবে হানাদার মুক্ত হয় সিলেট

প্রকাশিত: ৭:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৭, ২০২৩

যে ভাবে হানাদার মুক্ত হয় সিলেট

সুনির্মল সেন :
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধে সবধরনের সহায়তাকারী প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর পর সিলেট শহরে পাক হানাদারদের ওপর আকাশ পথে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে । তারপর জোরদার হয়ে উঠে গেরিলা তৎপরতা। এছাড়া ১৩ই ডিসেম্বর দুপুরে পশ্চিমাদের পাল্টা বিমান হামলা উপেক্ষা করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি দল সিলেট শহরের পূর্বদিকে খাদিমনগরে পৌঁছে যায়। প্রায় একই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য দু’টি দল দক্ষিণ দিকে জালালপুর ও পশ্চিম দিকে লামাকাজীতে অবস্থান গ্রহণ করে । ফলে খান সেনারা কোনঠাসা হয়ে যায়। একমাত্র উত্তর দিকে খোলা থাকলেও বিস্তীর্ণ পাহাড় ও সীমান্ত থাকায় জল্লাদদের সেদিকে পালানোর কোন উপায় ছিল না। খাদিমনগর থেকে বিকেলে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা একটি গাড়িতে মাইক বেধে পাক হানাদারদের প্রতি আত্মসমর্পনের আহবান জানাতে জানাতে সিলেট শহরের দিকে এগুতে থাকেন। এ সময় পেছনে অন্য একটি গাড়ীতে করে মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল (১) এর বেসামরিক উপদেষ্টা তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল বাগচী অগ্রসর হলেও সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কাছে শত্রুদের প্রতিরোধ ও আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতির দরুন সবাইকে ফিরে যেতে হয়। পরদিন দুপুরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও কর্নেল বাগচী নির্বিঘ্নে সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। এমনকি সালুটিকর পশ্চিমাদের মুল ঘাটি বর্তমানে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুরে আসতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ‘জেড’ ফোর্সও আলুতলে সরকারি দুগ্ধ খামারের নিকট পৌছে যায়। এতে পাক হানাদাররা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এক সময় রাতের আধার ঘনিয়ে আসে। সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর জওয়ানরা বীরদর্পে দলে দলে ঢুকতে শুরু করে শহরে। পাশাপাশি রাজপথে মুক্তির আনন্দে উল্লসিত জনতার ঢল নামে। পরদিন অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর সিলেটকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে খান সেনারা আরো একদিন পর আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ করে।

 

সুনামগঞ্জ : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বপ্রান্তের তৎকালীন মহকুমা এবং বর্তমান জেলা শহর সুনামগঞ্জ একাত্তরের ৭ই ডিসেম্বর পশ্চিামা জল্লাদ বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। সুনামগঞ্জ শহর মুক্তকরণ অভিযানে মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরভূক্ত বালাট সাব সেক্টর অধিনায়ক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অন্যতম আসামি মেজর (অব.) এম.এ মুত্তালিব এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যান্টেন যাদব ও ক্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগরের যৌথ নেতৃত্বে প্রায় ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ৩ জন ওয়ারলেস অপারেটর অংশ নেন। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার খবর বেতারে শোনামাত্র মেজর (অব.) ভাটনগরের সাথে এ ব্যাপারে আগে থেকেই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ই ডিসেমএবর সন্ধ্যার পর মেজর (অব.) এম.এ মুত্তালিব ও ক্যাপ্টেন যাদব বনগাও থেকে যথাক্রমে যোগিরগাও ও আমবাড়ি এবং ব্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগর চিনাকান্দি হতে গৌরারং রওয়ানা দেন। সবার মূল লক্ষ্য সুনামগঞ্জ শহর। প্রত্যেকের সাথে কমবেশি একহাজার করে মুক্তিযোদ্ধা ও একজন করে ভারতীয় ওয়ারলেস অপারেটার। আর অভিযান সংকেত ‘খরগোশ’। প্রতিটি দল কাদা-পানিভেঙ্গে কখনো নৌকায় আবার কখনো হেটে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলে। মধ্যরাতের আগেই সহযোদ্ধাদের নিয়ে মেজর (অব.) এম.এ মুত্তালিব সুনামগঞ্জ শহরতলির যোগিরগাঁও পৌঁছে যান। ক্যাপ্টেন যাদব এবং ক্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগরের নেতৃত্বাধীন দল দু’টিও সামনে স্থানে সুরমা নদী অতিক্রম করে সামনে এগুতে থাকে। অতঃপর ওয়ারলেসে ঘনঘন যোগাযোগ চলে। এভাবে এক সময় ভোর হয়ে আসে। ইতোমধ্যে শত্রুর বুঝে ঝাপিয়ে পড়তে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড উৎসাহ জেগে উঠে। রক্ত টগবগ করতে শুরু করে। পরদিন ৭ ডিসেম্বর। নতুন সূর্যালোকে পূবের আকাশ উজ্জল হবার সাথে সাথে বাংলার অকুতোভয় সন্তানরা সুনামগঞ্জ শহরের বুকে বিজয় চিহ্ন একে দিতে সক্ষম হন। কোন প্রতিরোধের সম্মুখিন হতে হয় না। কারণ পশ্চিমা হায়েনার দল আগের রাতেই পলায়ন করে। বালাট সাব সেক্টর অধিনায়ক মেজর (অব.) এম.এ মুত্তালিব সেই গৌরবময় মুহুর্তের স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছিলেন, সহযোদ্ধাদের নিয়ে সকাল ৬টার দিকে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে শহরে ঢুকি। এর আগে ক্যাপ্টেন যাদব সুনামগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের কাছে ও ক্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগর বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের নিকট পৌছে যান; কিন্তু কোথাও শত্রুর দেখা নেই। পথঘাট জন শূন্য। অবশ্য কিছু সময় পরেই চারদিক থেকে লোকজন আনন্দে ‘গনবিদারী ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি তুলে ছুটে আসতে থাকে। অনেকের হাতে সবুজের বুকে লাল সূর্যের মাঝে সোনালী মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা। সবার মাঝে সে কি উদ্দীপনা। মুক্তিযোদ্ধা-জনতার সেই অন্তরঙ্গ মুহুর্তটি এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী ৪ঠা ডিসেম্বর বিকেল ৪ টার দিকে জেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে কালেঙ্গা নামক স্থানে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। সেখানে বড়টিলায় পশ্চিমাদের সাথে হয় প্রচন্ড যুদ্ধ। এতে ১২৭ জন মিত্র সেনা মারা যান। পরদিন পাকিস্তানি ঘাটিগুলোর উপর আরম্ভ করা হয় বিমান হামলা। তাই বেকায়দায় পড়ে যায় পশ্চিমা জল্লাদরা। উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত মৌলভীবাজার ছেড়ে সিলেট জেলা সদরের দিকে পালাতে শুরু করে। এ সময় বর্বর পাক সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণে বাঙালি হতাহত হয়। হায়েনার দল প্রথমে অবস্থান নেয় শেরপুরে, কিন্তু সেখানেও টিকতে না পেরে সোজাসুজি সিলেট জেলা সদরে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে মৌলভীবাজার হয়ে যায় শত্রুমুক্ত। সেদিন ছিল ৮ই ডিসেম্বর, যেদিন এই জেলা সদরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় মুক্ত বলে। পরে আওয়ামীলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

বালাগঞ্জ : একাত্তরের ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর জন্মস্থান। বালাগঞ্জ উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। ভারতের রাতাছাড়া থেকে ২রা ডিসেম্বর সকাল ৬টায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা (মুজিব বাহিনী) বালাগঞ্জের উদ্দেশ্যে হেটে রওয়ানা দেন। অধিনায়ক আজিজুল কামাল। সহযোদ্ধা মছব্বির, শফিকুর রহমান, মনির উদ্দিন, মজির উদ্দিন, ধীরেন্দ্র কুমার দে, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল বারী, সমুজ আলী, আব্দুল খালেক, জমেদ আলী, আমান উদ্দিন, লাল মিয়া প্রমুখ। এরমধ্যে ২৬ জন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পথে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা সদরে থেকে যান। অবশিষ্ট ১৪ জনের দলটি ৪টা ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অধিনায়ক সহ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মাইজগাঁও এলাকায় আব্দুল গণি মাষ্টার ও বদরুল হক নিলোর বাড়িতে উঠে। সেখান থেকে রাত ১২টা রওয়ানা হয়ে ২টায় ইলাশপুর রেল সেতুর নিকট অবস্থান গ্রহণ করে। পরদিন ভোর ৫টায় একদল পাক সেনা সিলেট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর মুখোমুখি হয়। আনুমানিক আধাঘন্টা যুদ্ধ চলে। পশ্চিমারা শেষ পর্যন্ত ২টি এসকেএস রাইফেল ও বেশ কিছু গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সগর্বে ইলাশপুর সেতুর উপর অধিকার স্থাপন করেন। বড়লেখা থেকে সেই ২৬ জনের দলটিও এসে পৌছে যায়। এতে মনোবল যায় আরো বেড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতুর অবস্থান থেকে ৬ই ডিসেম্বর ভোর রাতে রওয়ানা হয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্পের কাছে সকাল ৭টায় পৌছতে সক্ষম হন।

এরপর তথ্য সংগ্রহের পালা। খবর পাওয়া গেলো, পাক হানাদার নেই। তবে নোয়াখালির অধিবাসী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে একদল বাঙালি পুলিশ রয়েছে। রাজশাহীর লোক কানুনগো বদিউজ্জামান ও বিয়ানীবাজার নিবাসী ডা. জাকারিয়া বার্তা বাহকের কাজ করছিলেন। ইতোমধ্যে রাত নেমে আসে। মুক্তিযোদ্ধারাও থানা ভবনে অবস্থানকারী পুলিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলেন। পরদিন সকালে বার্তা বাহক দু’জনকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাঠানো হয়। পুলিশ বাহিনী তখন দু’ঘন্টা সময় চায়, কিন্তু অধিনায়ক আজিজুল কামাল ঘোষণা করেন, বড়জোর দশ মিনিট সময় দেয়া যেতে পারে। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয়, পাক হায়েনাদের এই দোসররা সকাল নয় টায় আত্মসমর্পন করবে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ বাহিনী থানা ভবনের মালখানায় অস্ত্রগুলো জমা দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল পৌনে ১০ টায় বালাগঞ্জ ডাকবাংলোয় মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কের নিকট চাবি হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসমর্পন করে। আজিজুল কামাল সকাল ১১ টায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি পশ্চিমা হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

জালালপুর : পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেট সদর উপজেলার জালালপুর এলাকাকে বলতো ‘সেকেন্ড ইন্ডিয়া’। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুব বেশি সেখানে যায়নি। যুদ্ধ চলাকালে খুব বেশি সেখানে যায়নি। আশংকা করতো গেলে একজনও ফিরে আসতে পারবে না। জালালপুর সিলেট শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওই এলাকার প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ সমর্থক। পাকিস্তানপন্থী ছিলনা কেউ। এজন্যেই সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পথে শরণার্থীরা প্রথমে সেখানে গিয়ে উঠতেন। থাকতেন এবং বিশ্রাম নিতেন দু’একদিন। এরপর গন্তব্যের দিকে আবার পা বাড়াতেন। পাক হানাদাররা মনে করতো জালালপুরের মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাটি রয়েছে। এ কারণে ওই এলাকার দিকে অগ্রসর হবার সাহস পেতো না। তবে দালালরা প্রায়ই নিয়ে যাবার অপচেষ্টা চালাতো। যদিও পশ্চিমা জল্লাদদের ধারণা ছিল এরকম, কিন্তু আসলে জালালপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি পৌঁছে একাত্তরের ২২শে অক্টোবর। এতে সদস্য সংখ্যা ছিল ২১ এবং অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন ন্যাপ কর্মী এবং পরর্তীতে গণতন্ত্রী পার্টি জেলা শাখার অন্যতম সহ সভাপতি সুবল চন্দ্র পাল। কয়েকদিন পর কিছু সংখ্যক সহযোদ্ধা সেখানে পৌঁছেন। এই ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধার ওপর দায়িত্ব ছিল, শত্রুদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই তারা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতে থাকেন । গেরিলা কায়দায় অর্থাৎ হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে আঘাত হানতে শুরু করেন নিকটবর্তী রাজাকার অবস্থান গুলোতে। তাদের এই তৎপরতা ভাল ফল দেয়। এ কান ও কান হয়ে পশ্চিমাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়, জালালপুর এলাকায় কমপক্ষে ৫শ মুক্তিসেনা অবস্থান নিয়েছে। প্রত্যেক আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। তাদেরকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়েই পাঠানো হয়েছে। পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা এ খবর বিশ্বাস করে নিয়েছিল। তাই দালালদের বহু অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও জালালপুর এলাকামুখী হয়নি। যদ্দুর জানা গেছে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জালালপুরে অবস্থানকালে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নগদ অর্থ ও রসদ সরবরাহ করতেন ন্যাপ জেলা শাখার তখনকার সহ সভাপতি আব্দুল হামিদ (কদমতলী)। অন্যান্য সহযোগিতা যেমন থাকা, খাওয়া, যাতায়াত, সংবাদ আদান-প্রধান, পথ প্রদর্শন ইত্যাদি কাজ করতেন সরিষপুরের টুনু মিয়া, রায়খাইলের জমশেদ আলী, নকি বড়চকের সোনাহর আলী, মাসুক মিয়া, পূর্বভাগের তেরা মিয়া, কাদিপুরের সাইজাল মিয়া প্রমুখ। এছাড়া এলাকার সাধারণ মানুষও বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করতেন। ভারত ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরদিন জালালপুরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় মুক্ত এলাকা। সেদিন বিকেলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি সুফি মিয়া জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

ফেঞ্চুগঞ্জ : ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৪ই এপ্রিল পশ্চিমা হানাদার বাহিনী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে প্রবেশ করে। এর সাথে সথেই দালালদের সহায়তায় মেতে উঠে হত্যা-নির্যাতনযজ্ঞে। হানাদার বাহিনীর হাতে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আসাদুজ্জামান বাচ্চু প্রথম শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে শক্ত ঘাটি গড়ে তুলে। ফেঞ্চুগঞ্জ প্রাকৃতিক গ্যাস সার কারখানার ঘাটিতে চালাতো নারী নির্যাতন। পশ্চিমবাজারে বিশাল কাইয়ার গুদাম পরিণত হয় হানাদারদের বন্দিশালায়। হত্যা নির্যাতনে কত বাঙালির বুকের রক্তে সিক্ত হয়েছে কাইয়ার গুদাম তা আজো জানা যায়নি। প্রতিরাতে বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হতো। এরপর কুশিয়ারার বুকে লাশ ভাসিয়ে দিতো জল্লাদরা। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হাবার পর কাইয়ার গুদামে শত শত জনতার ভিড় জমে এবং স্বজনহারাদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে। ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাবার পূর্বে বর্বর হানাদাররা  কুশিয়ারার দক্ষিণ পারে (বাজার ও রাজনপুর এলাকায়) বিরাট গাড়ির বহর পুড়িয়ে দেয়। অন্যান্য যুদ্ধ সামগ্রীও বিনষ্ট করে। অনেক খন্ড যুদ্ধের পর ১০ই ডিসেম্বরে হয় বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ। কুশিয়ারা নদীর উত্তরপারে হানাদাররা অবস্থান নেয়। দক্ষিণপার থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী কুশিয়ারা রেল সেতুর উপর দিয়ে উত্তরপারের দিকে অগ্রসর হয়। তখন অতর্কিত আক্রমণ করে পাক সেনারা। সেতুর উপর সারিবদ্ধ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা মহুর্তের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়েন নদীর বুকে। এ যুদ্ধে কতজন মুক্তিসেনা ও মিত্র সেনা শহীদ হয়েছিলেন তা জানা যায়নি। তবে উত্তরপারের ধান খেতে ও ব্যাংকারে ৫ জন শত্রু সেনার লাশ পাওয়া যায়। বীর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হয় পাক হানাদাররা। পরদিন ফেঞ্চুগঞ্জের মাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তারা।

ছাতক : উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিল্প শহর ছাতক একাত্তরের ৮ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে পশ্চিমা জল্লাদরা দ্রুত পিছিয়ে যেতে আরম্ভ করে। কারণ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র সেনারা চারদিক থেকে প্রচন্ড আঘাত হানতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী সুরমা নদীর উত্তর পারে অবস্থিত ছাতক সিমেন্ট কারখানার অবস্থান ছেড়ে দক্ষিণ তীরে উপজেলা সদরে এসে জড়ো হয় । মুক্তিযুদ্ধের ৫নম্বর সেক্টরের সেলা সাব সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ.এস হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল ছাতক সিমেন্ট কারখানায় নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায়। তখন সেখানে জনমানবের কোন চিহ্ন ছিলনা। মনে হচ্ছিল যেন মৃতপুরী। তবে বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তানি জল্লাদরা খুব বেশি সময় আগে পালায়নি। বড়জোর অপরপারে উপজেলা সদর পর্যন্ত ততক্ষণে পৌঁছেছে। পার্শ্ববর্তী দোয়ারাবাজার উপজেলাধীন বাংলাবাজার নামক সীমান্তবর্তী অবস্থান থেকে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ৭ই ডিসেম্বর সকাল ১০ টার দিকে রওয়ানা হয়ে বিকেল ৪টা নাগাদ ছাতক সিমেন্ট কারখানায় পৌছে। অধিনায়ক মো. আব্দুস সামাদ। সহযোদ্ধা জিয়ন কুমার দাস মিন্টু, আব্দুল হান্নান, আব্দুল কাদির, ব্যারিস্টার আব্দুল হাসিব, নুরুল আমিন প্রমুখ। এ অবস্থানে পৌছার পর দেখা হয়ে যায় ক্যাপ্টেন এ.এস হেলাল উদ্দিনের সাথে সবাই একই সাব সেক্টরের। রাত কাটে এক সঙ্গে। এই সুযোগে অভিযান পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী পরদিন সকাল আনুমানিক ৮টায় বিনা বাধায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে দেখা যায় উপজেলা সদর হানাদার শূণ্য। একথা প্রচারিত হওয়া মাত্র রাজপথে মুক্তি মানুষের ঢল নামে।

জকিগঞ্জ : জকিগঞ্জ উপজেলা সদর এ অঞ্চলের প্রথম মুক্ত এলাকা। সেখানে মুক্তি আসে ২১শে নভেম্বর। এই সাফল্য পরবর্তী প্রতিটি অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহ যোগায়। ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর; “তন্ত চাঁদ তুমি ফিরে যাও, এবার মোরা করবোনা ঈদ-এদৃপ্ত শপথে বলী- য়ান বাংলার সূর্যসন্তানরা সেদিনই জকিগঞ্জ উপজেলা সদরে বর্বর খান সেনাদরে ওপর শেষ আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। এ লক্ষ্যে সন্ধ্যায় কুশিয়ারা নদীর ওপারে ভারতের কমিরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্বঅঞ্চল (১) এর বেসামরিক উপদেষ্টা তখনকার জাতীয় পরিষদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজীর উপস্থিতিতে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে সেদিন সন্ধ্যার পর কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জকিগঞ্জ থেকে খানিকটা উত্তরে এবং আরেকটি দল কিছুটা দক্ষিণে সরে অগ্রসর হতে থাকে। দল দুটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান গ্রহণের পর পূর্বদিক হতে আক্রমণ রচনা করা হয় সরাসরি উপজেলা সদরে। এর জবাব দেয় খান সেনারা। তাই বাধে প্রচন্ড যুদ্ধ। এতে উভয়দিকে বেশ ক’জন হতাহত হয়। আনুমানিক পরদিন রোববার ভোর ৫টার দিকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী একমাত্র খোলা থাকা পথ সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক ধরে পশ্চিমদিকে পলায়ন করে। এরপরই সীমান্ত সংলগ্ন এ উপজেলা সদরে প্রবেশ করেন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুল লতিফ, আওয়ামীলীগ নেতা ইসমত আহমদ চৌধুরী, ন্যাপ নেতা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা। রাজপথে নামে স্বাধীনতা প্রিয় মুক্ত জনতার ঢল। ঘরে ঘরে বয়ে যায় আনন্দের বান। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার বুক চিরে বেরিয়ে আসে স্বস্তির নিঃশ্বাস। উল্লাসিত মানুষজন মুহুর্তের জন্যে হলেও ভুলে যায় স্বজন হারানোর ব্যাথা। এক পর্যায়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল আনুমানিক ৯টায় দেওয়ান ফরিদ গাজী ও ৪নং সেক্টর অধিনায়ক লে. কর্নেল সি.আর দত্ত সহ অন্যান্য বিজয়ের গর্বে গর্বিত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি পৌঁছে যান জকিগঞ্জ উপজেলা সদরে। পরদিন আসেন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এনাম আহমদ চৌধুরী, মাসুক উদ্দিন আহমদ, আহমদ আল কবির, এনামুল মজিদ চৌধুরী, বেলায়েত হোসেন, মোস্তাকিম হায়দার, খলিল উদ্দিন প্রমুখ। সন্ধ্যা নাগাদ লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স ও এসে পৌছে যায়। উল্লেখ্য, জকিগঞ্জ উপজেলা সদর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করার সময় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর চমন লাল মারা যান।

বাহুবল : পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন কোণঠানা। একের পর এক মুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ রক্তেভেজা এলাকা। পশ্চিমাদের দোসর দালাল- রাজাকারদের চোখে ঘুম নেই । যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে কিংবা আত্মগোপন করছে। এসময় হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলা সদরকে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের কবল থেকে মুক্ত করতে ৩০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা দায়িত্ব পান। অধিনায়ক কাইয়ুম। সহযোদ্ধা এম.এ.রউফ, আব্দুল গণি, মফিল উদ্দিন, ময়না মিয়া প্রমুখ প্রিয় স্বদেশের পবিত্র মাটিকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধার করতে সবাই দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করলেন। যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব সেক্টর সদর দপ্তর থেকে বাহুবল উপজেলার খাগাউড়া গ্রামে পৌছেন। এরপর ১লা ডিসেম্বর রাত ৮টায় রওয়ানা হন লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশ্যে । প্রথমে নৌকায় ৫ কিলোমিটার ও পায়ে হেটে আরো দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্টস্থানে পৌছতে হয়। অতঃপর পশ্চিমাদের ঘাটি থানা ভবনকে সামনে রেখে অবস্থান গ্রহণ করতে রাত ৪টা বেজে যায়। এবার আক্রমণ। তখন ২রা ডিসেম্বর ভোর ৫টা। বাহুবল থানা ভবনের দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অবিরাম গোলা বর্ষণ শুরু করেন। পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি জল্লাদরা; কিন্তু শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে পালাতে আরম্ভ করে। অভিযান সমাপ্ত হলে লাগে দেড় ঘন্টা। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা একটি গ্রেনেডও ব্যবহার করেন। তবে অন্য কোন ক্ষতি ছাড়াই পাক বাহিনীর দোসর ৩ জন পুলিশকে আটক এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

 

(সুরমামেইল/এফএ)


সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com