সিলেট ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:০৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
প্রচণ্ড গরম। রোদের তীব্রতা এনেছে চরম অস্বস্তি। উপচেপড়া মানুষ আর যানবাহনের ভীড়ে রাজধানী ঢাকা প্রায় বেসামাল। এই তীব্র গরম আর বেপোরোয়া যানজট অসহনীয় করে তুলছে নগরীর জনজীবন। ঢাকায় গাছ কমেছে , জলাশয় কমেছে, কমেছে তাপরোধক আবাসন। আগে বিল্ডিং তৈরির সময় ইট-কাঠের যে পরিমাণ ব্যবহার হতো, তা ছিল তাপরোধক। এখন বিল্ডিং নির্মাণে কাচের ব্যবহার বহুল পরিমাণে বাড়ায় শহরের তাপমাত্রা গেছে আরও বেড়ে। নগরায়ণের সঙ্গে-সঙ্গে বেড়েছে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ব্যবহারও। সেটাও শেষ বিচারে নগরীর তাপমাত্রা বাড়াতেই সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, ঢাকাকে ঘিরে থাকা নদীগুলোকেও আমরা হত্যা করেছি দিনের পর দিন-আমাদের লোভ আর লাভের কাছে। ঢাকার চারপাশ বেষ্টন করে থাকা নদীগুলোকে দখল আর দূষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও হয়ত ঢাকার সামগ্রিক আবহাওয়া কিছুটা বাসযোগ্য থাকত। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত লোভ আর নিয়ম না মানার সংস্কৃতি ঢাকাকে প্রায় বাসের অযোগ্য একটা নগরীতেই পরিণত করেছে। কাজেই ঢাকা সব ভৌত অবকাঠামোর সুবিধা দিচ্ছে বটে কিন্তু সহনশীল, আনন্দময় বাসযোগ্য একটা নগর থাকছে না। এই অসহনীয়তার মধ্যে আমাদের জীবনকে আরও বড় দুঃখের দিকে ঠেলে দিচ্ছে নিত্য নতুন শিশু হত্যার খবর। সর্বশেষ সংবাদপত্রের এ বিষয়ক খবরের শিরোনাম হচ্ছে, ‘শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার’।
এই খবর বলছে, দিনাজপুরের হিলিতে চার বছরের এক ‘শিশুর’ বস্তাবন্দি লাশ এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটি বাড়ির উঠানের সামনে খেলতে যায়। ঘণ্টাখানেক পর তার মা আর শিশুটিকে উঠানে পাননি। পরে আশেপাশের বাড়ি, বাড়ির পাশের মাঠ, ঝোপঝাড়, পুকুর, ডোবা সর্বত্র খোঁজা হয়। কিন্তু শিশুটির দেখা আর মেলেনি।পরে আশেপাশের দুই থানায় মাইকিং করা হয়। থানায় জিডিও করা হয়। এরইমধ্যে শিশুর বাবার মোবাইলে মেসেজ আসে অপহরণকারীদের। তিনলাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পুলিশকে জানায় শিশুটির বাবা। পরে পুলিশি তৎপরতায় শিশুটির এক প্রতিবেশীর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বস্তাবন্দি লাশ।
দুই.
শিশুহত্যার বিষয়ে পাওয়া সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আমাদের উদ্বিগ্ন করে। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে শিশুহত্যা হয়েছে ১ হাজার ১৩৪ জন। ২০১২ সাল থেকে পাওয়া এই তথ্য বলছে ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন, ২০১৫ সালে ২৯২ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিশুহত্যার সংখ্যা ৭৫। গত ৩ বছরে ৮৭৬ জন এবং গত ৩ মাসে ৭৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
শিশু হত্যার কায়দাগুলোও বিভৎস। নানাভাবে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যা , অপহরণের পর হত্যা, রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যা, মা-বাবার হাতে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা তো ঘটছেই। আবার নবজাতকের মৃতদেহও পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। নিখোঁজের পরও লাশ মিলছে শিশুদের। গৃহকর্মী শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। নবজাতকের খুন ঘটছে। প্রতিপক্ষের রোষ মেটাতে খুন করা হচ্ছে শিশুদের। পরিবারের মধ্যে বাবা-মার নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেও খুন হচ্ছে শিশুরা। অপহরণ, গুম, খুনের শিকার শিশুদের কথা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে বেদনাবহ সংবাদ হয়ে দেখা দিচ্ছে। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, সোমবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘দেশে শিশুহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে এত জিঘাংসা কেন? যারা শিশু হত্যা করে, তারা সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্য জীব। এর চেয়ে জঘন্য, নোংরামি কাজ আর কী হতে পারে?’
তিন.
শিশুরা খুন হচ্ছে। বলা যায়, সিদ্ধহস্তে আমরাই খুন করছি শিশুদের। শিশুরা ক্ষমতা কাঠামোর প্রান্তিকে অবস্থিত বলেই হয়তো শক্তিমানরা নানা কারণে শিশুদের খুন করে তাদের কার্যোদ্ধার করছেন। এক অর্থে সমাজের ক্ষমতা কাঠামোর ওপর স্তরের শক্তিমানদের লোভ আর অন্যায্য লাভের টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা। সমাজের মধ্যেই হয়তো শিশুহত্যার সব কারণ আর উপাদান বিদ্যমান:
০১. অসহিষ্ণুতা, অসততা, অনৈতিকতা, অন্যায্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা নানাভাবে সমাজে তৈরি করছে প্রতিশোধস্পৃহা। প্রতিপক্ষকে নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করার সবচাইতে সহজ উপায় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে শিশুরা। শিশুকে অপহরণ, গুম, খুন বা শিশুর বস্তাবন্দি লাশ উপহার দিয়ে প্রতিপক্ষকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা তাই সমাজে ভীষণভাবে বাড়ছে।
০২. সমাজের সর্বত্র অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অবিশ্বাস আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরস্পরবিরোধীভাবে ব্যক্তিমানুষকে অস্থির করে তুলেছে। ব্যক্তিমানুষের ভাবনায়, কর্মে কোনও সুস্থিরতা থাকছে না। বিবেচনায় মিলছে না বিচক্ষণতা। ব্যক্তির সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হচ্ছে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায়। সেখানে বড় রকমের ভুল হচ্ছে। সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছে শিশুরা।
০৩.সমাজ কাঠামোর প্রত্যেক স্তরে এই বার্তাই এখন সুস্পষ্ট যে, ‘সবল দুর্বলকে নিপীড়ন করবে’। সবলকেই সবাই সুরক্ষা দেবে, দুর্বলকে নয়। সে কারণেই সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বল ও প্রায় অরক্ষিত অংশ শিশুদের ওপর নিগ্রহ, নির্যাতন, নিপীড়ন বাড়ছে।
০৪. সমাজ কাঠামোর কোনও-কোনও স্তরে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে। তার প্রভাবে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের উৎপত্তি ঘটছে। একক পরিবারের লক্ষ্য এখন সমষ্টির উন্নতি নয়, ব্যক্তির বৈষয়িক উন্নতি। এই ঐকান্তিক দ্রুতগতির উন্নতি, চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যে গ্যাপ তৈরি করছে, তা ছোট পরিবারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে। ছোট পরিবারের দুই বিন্দু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ। এই অসন্তোষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, জৈবিক, সাংসারিক চাহিদার ক্ষেত্রে তৈরি করছে বহুমাত্রিক বহুগামিতা। সেই বহুগামিতা বহুরকমের অসন্তুষ্টির উদগাতা। ফলে পরিবারের নিটোল সুখ আর আনন্দ ক্রমশ পরিণত হচ্ছে বিষাদে। এই বিষাদ পরিবারের শিশুদের মনোজগতে তৈরি করছে নানান বিকৃতি। এক মনোবৈকল্য তাদের নিটোল জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। মাদকাসক্তি, প্রযুক্তি আসক্তি, স্ক্রিননির্ভরতায় তারা হারিয়ে ফেলছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ। এই অস্বাভাবিকতার পথে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা ও বিপদ। শিশুরা অহরহ শিকার হচ্ছে তার।
০৫. রাষ্ট্রের আচরণে, ভাষায়, প্রয়োগে কোথাও ন্যায্যতা সুস্পষ্টভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। এখানে নির্বাচন হয় গায়ের জোরে। আধিপত্যবাদীকেই এখন বাংলাদেশে ক্ষমতাবান হিসেবে দেখা হয়। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনমানসে যে হিংস্রতা, যে দায়মুক্তির অবয়ব দাঁড় করিয়েছে, তাই দুর্বলকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে সবলকে উৎসাহিত করছে। দুর্বল হিসেবে শিশুরা সেই রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতির নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে।
০৬. প্রযুক্তি আর আকাশ সংস্কৃতির বল্গাহীন অনুপ্রবেশ আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় মূল্যবোধে এক বিরাট অবক্ষয়ের সুযোগ এনে দিয়েছে। ক্ষোভ-প্রতিহিংসা-শত্রুহননের ক্ষিপ্ততা যে মূল্যবোধজনিত উপাদান দিয়ে উপশমের সুযোগ ছিল, তার শূন্যতা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে। ফলে, মানুষ নিজের ক্রোধ বা প্রতিহিংসাকে দমন করার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছে না। সব ধরনের মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই সেখানে জ্বালাচ্ছে হিংসার আগুন। শিশুরা পুড়ছে সেই আগুনে।
০৭. নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে সর্বত্র। রাষ্ট্রে বাড়ছে। বাড়ছে পরিবারেও। ফলে নিজেদের ঘরে বাবা-মার আশ্রয়েও নিরাপদ থাকছে না শিশুরা। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা অনেক সময় তাই বড় সর্বনাশের কারণ হচ্ছে। যেকোনও উপায়ে দ্রুত ধনী হওয়ার, দ্রুত সফল হওয়ার, দ্রুত পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার শর্টকার্ট মেথড সমাজকে এত তীব্রভাবে প্রভাবিত করছে, দ্রুত শত্রুহননের, দ্রুত বিচারের দায় নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে শিশুদের হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতেও বিচলিত হচ্ছে না ‘নিরাপত্তাহীন’ ব্যক্তিমানুষ।
চার. শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশকেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। আমাদের উন্নয়ন ভাবনাতেও শিশুদের গুরুত্ব খুব একটা নেই। খেলার মাঠ, পার্কসহ শিশুদের প্রাকৃতিক বিকাশের সব পথ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বাড়ছে তাদের ওপর নিরস পাঠ্যবইয়ের অসহনীয় চাপ। শিশুদের জীবনে কোনও বিশ্রাম নেই। তারা কেবল ছুটছেই। স্বচ্ছল পরিবারের শিশুরা অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট হচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অভাবের শিকার হয়ে পিষ্ট হচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই অসংখ্য শিশুকে আমরা প্রতিদিন হত্যা করছি। শিশুমনকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছি না। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন— তার নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি আর কট্টর শাসন দিয়ে প্রতিদিন ঘরে ঘরে হত্যা করছে শিশুর সৃজনশীল মন।
মাঝখানে শিশু নির্যাতনের কিছু ঘটনা সমাজে আলোড়ন তুলেছিল। তার ফলে শিশু রাজনসহ বেশ কিছু শিশুকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ঘটনার দ্রুত বিচারও হয়েছে। আবার নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি আজও। ত্বকীর হত্যার বিচার চেয়ে তার বাবা বরং চক্ষুশূল হয়েছে সমাজপতিদের।
পাঁচ. আমরা যদি সমাজকে, রাষ্ট্রকে অসহিষ্ণু, প্রতিশোধপরায়ণ রেখে দেই তবে এই অবস্থা বদলাবে না। অমানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু রেখে, ভোগবাদী বিশৃঙ্খলা সমাজকাঠামো সচল রেখে শিশুদের জীবন নিরাপদ করা যাবে না। শিশুহত্যার মিছিল চলবেই। নানান কায়দায়, নানা নামে, নানাভাবে শিশু হত্যায় সিদ্ধহস্ত এই প্রবণতা বহাল থাকবেই। মানবিক, সংবেদনশীল, পরমতসহিষ্ণু, ন্যায্যতামানা রাষ্ট্র তৈরি করার কাজটা এখন তাই জরুরি।
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি