সিলেট ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:১৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬
সুরমা মেইল নিউজ : হবিগঞ্জ বাহুবলের ৪ শিশুহত্যার মূলহোতা আব্দুল আলী বাগাল। মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। সুন্দ্রাটিকি ও তার আশপাশের এলাকার একাধিক খুন, ডাকাতি, যৌন হয়রানি, বাগান দখলের ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে তার ও ছেলেদের নামে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ এমন কোনো কর্ম নেই যা তারা করেনি, করতে পারে না। অনেক অপকর্মের নেপথ্য নায়ক আব্দুল আলী বাগাল ও তার ছেলে জুয়েল বর্তমানে চার শিশু হত্যার অভিযোগে ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে আছেন। অপর ছেলে রুবেল বাবা আব্দুল আলী বাগালকে হুকুমদাতা আখ্যা দিয়ে হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
কে এই আব্দুল আলী বাগাল?
বাহুবল উপজেলার রশিদপুর ও ফয়জাবাদ চা বাগানঘেষা নিভৃত পল্লীগ্রামটির নাম সুন্দ্রাটিকি। বাহুবল সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার। এ গ্রামের বেশ কিছুসংখ্যক লোক চা, লেবু, আনারস বাগান ইত্যাদিতে শ্রমিক ও মালিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে আব্দুল আলী জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বহু বছর আগে ফয়জাবাদ চা বাগানে পাহারাদার (আঞ্চলিক ভাষায় বাগাল) এর কাজ নেন। দীর্ঘদিন তিনি ওই পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে তার নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘বাগাল’। বর্তমানে তার বড় ছেলে বিলাল মিয়াও একই পেশায় যুক্ত। এ পেশায় যুক্ত থাকার সুবাদে ইতোমধ্যে তিনি চা বাগানের বেশকিছু ভূমি দখল করে ফল বাগান প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার দখলে বাগানের আরও কিছু ধানের জমিও আছে বলে জানা গেছে। প্রায় ২৫ বছর আগে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে জলিল নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ওই ঘটনায় অভিযোগের আঙগুল উঠে আব্দুল আলী বাগালের দিকে। প্রায় ২০ বছর আগে রশিদপুর চা বাগানের নাচঘরের পাশ থেকে ভাদেশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতাচ্ছির মিয়ার ভাই মোশাহিদ মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ খুনের ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথা প্রচার হয়। পরবর্তী সময়ে উল্লেখিত দুটি খুনের ঘটনায় আপস রফার মাধ্যমে বেঁচে যান আব্দুল আলী বাগাল। প্রায় ২২ বছর আগে ফয়জাবাদ হিলসে শ্রীমঙ্গলের শিফার মিয়ার একটি ফল বাগান দখলকে ঘিরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। এ ঘটনায়ও তিনি ছিলেন নেতৃত্বে। যার ফলে তাকে কিছুদিন হাজতবাসও করতে হয়েছে।
এছাড়াও চা বাগানের গাছ পাচারে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে:-
এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল আলী বাগালের দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা বেগম বলেন, বাগান দখলের ঘটনায় তিনি (তার স্বামী) কিছুদিন হাজতবাস করেছেন। কিন্তু অন্য দু’টি মার্ডারে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার স্বামী আব্দুল আলীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। স্ত্রী দাবি করেন, তার স্বামী আপাদামস্তক ভালো মানুষ। ন্যায্য কথা বলে থাকেন, তাই তাকে অনেকে পছন্দ করে না।
বাগালের ছেলেরাও জড়িত অপকর্মে:-
আব্দুল আলীর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী আমেনা বেগম নিঃসন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা বেগমের ঘরে বিলাল মিয়া, জয়নাল মিয়া, ফেরদৌস মিয়া, জুয়েল মিয়া ও রুবেল মিয়া নামে ৫ ছেলে ও খেলা বানু ও নাসিমা বেগম নামে দুই মেয়ে রয়েছে।
আব্দুল আলী বাগালের ছেলেদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ:-
গুন্দ্রাটিকি গ্রামের ইদ্রিছ আলী জানান, বছরখানেক আগে তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। আব্দুল আলী বাগালের ছেলে বিলাল মিয়া ও তার ভাতিজারা এ ডাকাতি ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। এ ব্যাপারে তিনি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। এছাড়া, গত বছর ৩১ অক্টোবর ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের পাশে অবস্থিত ফয়জাবাদ হাইস্কুলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিল আব্দুল আলী বাগালের ছেলে; ওই বিদ্যালয়ের তৎকালীন ১০ শ্রেণির ছাত্র আলোচিত (৪ শিশু হত্যাকান্ডের দায় স্বীকারকারী) রুবেল মিয়া। সে ও তার কয়েক সহযোগি ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করতো। এ ব্যাপারে একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাশায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা স্কুলে হামলা-ভাঙচুর করে এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও শিক্ষকদের কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।
এছাড়ারাও ২০১৪ সালে দূর্গাপূজার নবমীর দিন আব্দুল আলী বাগালের এক ছেলেসহ কিছু বখাটে রশিদপুর চা বাগানে পূজানুষ্ঠানে এক চা শ্রমিক নারীকে যৌন হয়রানি করে। এ নিয়ে দশমীর পরদিন চা শ্রমিক ও সুন্দ্রাটিকি গ্রামবাসীর মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় চা শ্রমিকদের বেশ কিছু বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায়ও আব্দুল আলী বাগাল ও তার ছেলেরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
গুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েত:-
প্রায় চার হাজার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সুন্দ্রাটিকি গ্রাম। এ গ্রামে প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু আছে। সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে ৯ জন মুরব্বি রয়েছেন। গোষ্ঠীভিত্তিক এদের নেতৃত্বের পরিধি। গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরব্বিরা হলেন, (১) মাস্টার আব্দুল খালিক তালুকদার, (২) মধু মিয়া, (৩) নূর আলী ওরফে নূরাই মিয়া, (৪) আব্দুল আলী বাগাল ও আব্দুল মঈন সুমন, (৫) ফরিদ মিয়া ও সেলিম আহমেদ, (৬) টেনু মিয়া, (৭) আব্দুল হাই, (৮) উস্তার মিয়া ও (৯) আকল মিয়া। এদের অনেকেরই পিতা ছিলেন গোষ্ঠীর মুরব্বি। উল্লেখিত মুরব্বিদের সর্দার ছিলেন ফরিদ মিয়ার পিতা মৃত আব্দুল লতিফ। তার অবর্তমানে দায়িত্ব পালন করতেন আব্দুল মঈন সুমনের পিতা মৃত আব্দুর রউফ। বর্তমানেও তাদের উত্তরসূরিরা এ দায়িত্ব পালন করছেন।
গ্রাম্য মাতব্বর আব্দুল আলী বাগাল:-
গুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে আব্দুল আলী বাগাল মূলত একজন মাতব্বর (কৌশলী)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সনদধারী মুরব্বি নন। তিনি এক সময় ছিলেন মৃত আব্দুর রউফ মুরব্বির পাইক (পঞ্চায়েতের লোক)। চতুর, বাকপটু এবং কৌশলী মানুষ হওয়ায় গ্রাম পঞ্চায়েতে মাতব্বর হিসেবে তার কদর ছিল। আব্দুর রউফ মুরুব্বী মারা যাওয়ার পর রীতি অনুযায়ী ওই গোষ্ঠীর মুরব্বি হন তারই পুত্র আব্দুল মঈন সুমন। কিন্তু প্রায় জোর করেই এ দায়িত্ব দখল করেন আব্দুল আলী বাগাল। এ নিয়ে তাদের গোষ্ঠীর ভেতরে দ্বন্দ্ব চলমান আছে।
নিজগৃহে পরবাসী আব্দুল আলী বাগাল:-
সুন্দ্রটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতে আব্দুল আলী বাগাল ও তার অনুসারী মূলত নিজগৃহে পরবাসী। নানা বিষয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরব্বিরা ঐক্যমতে পৌঁছলেও আব্দুল আলী বাগাল একাই থেকে যান ভিন্ন মত ও পথে। ফলে গ্রামের নানা বিরোধ পঞ্চায়েতে শেষ হয়েও হয় না। অনেক বিষয়ই ফের জেগে ওঠে।
সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতের হেফাজতে কয়েক একর সরকারি পতিতভূমি রয়েছে। যা গোচারণ ভূমি, খেলার মাঠ ও কবরস্থান হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি এসব ভূমি তারা সরকারের নিয়ম মেনে লিজ নিয়েছেন। সম্প্রতি ওই ভূমি থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। ওই টাকা দিয়ে গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় খেলার মাঠে শিরনি রান্না করা হয়। ৯ গরু ও ১০ খাসি জবাই করে সুন্দ্রাটিকি গ্রামবাসী ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েক গ্রামের লোকজনকে ভুড়িভোজ করানো হয়। এতে প্রায় ৪ হাজার লোককে আপ্যায়ন করা হয়েছিল বলে গ্রামবাসীর দাবি। এতে ১০ লাখের কাছাকাছি অর্থ খরচ হয়। এ টাকার হিসাব-নিকাশ নিয়ে অন্য মুরুব্বীদের মাথা ব্যথা না থাকলেও আব্দুল আলী বাগালের সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল। এ নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে তিনি দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সব বিষয় নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্যান্য মুরব্বিদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে আব্দুল আলী বাগালের।
বড়ইগাছ নিয়ে বিরোধ:-
সর্বশেষ, মাস্টার আব্দুল খালিক তালুকদারের পঞ্চায়েতের মৃত মারফত উল্লার ছেলে কদ্দুছ, ফজল ও কাজল গং দের সঙ্গে রইছ উল্লার ছেলে ছায়েদ মিয়া গং দের বাড়ির সীমানার একটি বড়ই গাছকে কেন্দ্র করে বিরোধ বাধে। বিরোধটি মীমাংসা করতে গিয়ে দেখা যায় রইছ উল্লাহ ও তার ছেলেরা নিজ গোষ্ঠীর মুরব্বি মাস্টার আব্দুল খালিককে মানছে না। তারা পার্শ্ববর্তী গোষ্ঠীর মুরব্বি আব্দুল আলী বাগালকে তাদের মুরব্বি দাবি করছে। এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে দুই গোষ্ঠী বা দুই মুরব্বির পাইকদের মাঝে। ছোট এ বিরোধটি বড় হয়ে উঠার পেছনে আব্দুল আলী বাগালের হাত আছে বলে অভিযোগ উঠে। এ বিষয়টিসহ অতীত কর্মকান্ড নিয়ে গ্রামজুড়ে আব্দুল আলী বাগালের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে। এ নিয়ে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন আব্দুল আলী বাগাল ও তার অনুসারীরা। এ কারণেই উল্লিখিত চার শিশু হত্যা মিশন সংঘটিত হয়েছে বলে আলোচিত হচ্ছে এলাকায়।
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি