তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিশোর অপরাধ

প্রকাশিত: ৩:৩৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০২২

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিশোর অপরাধ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
সব অপরাধীই কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে থাকা চাই দীক্ষা এই দীক্ষা শিশুরা পায় পরিবার থেকে; সমাজ থেকে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্মকে নানাবিধ অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করার প্রধান কাজটি করতে হবে পরিবারকে। দেশে কিশোর ও তরুণ সমাজের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ইদানীং পত্রপত্রিকায় ‘কিশোর গ্যাং’-এর অপরাধ বিষয়ে প্রায়ই খবর বেরোচ্ছে। অপরাধের ধরনও দিন দিন পালটে যাচ্ছে। গ্যাং কালচার–যেমন ‘ব্যান্ডেজ গ্রুপের’ ‘মোল্লা রাব্বি’ ‘স্টার বন্ড’– বিস্তারের কারণে এক গ্রুপের ছেলেদের অন্য গ্রুপের ছেলেদের রামদা দিয়ে কোপাতে দেখা যায়। কোপানোর পর রামদা হাতে নিয়ে হিন্দি ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ গানের তালে নেচে উল্লাস করে এমন ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটকের ভিডিও বা টিকটক লাইকিকে কেন্দ্র করেও নতুন করে গ্যাং গড়ে উঠছে। টিকটকের নায়িকা বানানোর টোপ দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধও হচ্ছে। সম্প্রতি এক তরুণীকে পাচার করে ভারতে নিয়ে যৌন নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সেই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশি এক যুবকসহ পাঁচজনকে আটক করেছে কেরালা পুলিশ।

 

কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদেও। তারা অনায়াসে খুন, ড্রাগ, পর্নোগ্রাফি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপরাধে ইতোমধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে। পুলিশের তথ্যমতে, ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ নিয়ে বিরোধের জের ধরে হত্যাকা- ঘটে। এমনকি এক বছরের সিনিয়রের সামনে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অনলাইন গেম পাবজির মাধ্যমে অন্য কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করে এবং শেষে ব¬্যাকমেল করার মতো অপরাধেও ঝানু হয়ে উঠেছে তারা। গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত হওয়ার পাশাপাশি মাদক চোরাচালানেও জড়িত। কেউ কেউ নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র বহন করে। তারা এলাকায় প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিশোরদের মধ্যকার বিরোধে এ হত্যাক- ঘটে।

 

শিক্ষাহার ও মান বেড়েছে, অধিকাংশ পরিবারে বাবা-মা উভয়েই উচ্চ শিক্ষিত; তারপরও শিশু-কিশোরদের আচরণে এত অধঃপতন কেন? কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কি কিশোররাই দায়ী? এ জন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা। অপরাধ বিজ্ঞানে অপরাধের কারণ জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা হয়। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রেও এসব দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য। ফ্রয়েডের মতে, কিশোরদের মধ্যে সুপার ইগো প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে নানাবিধ লোভ-লালসার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়, বাধাবন্ধনহীন মুক্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায়।

 

সমাজবিজ্ঞান বলছে, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধুবান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। একে বলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণ বিনষ্ট হয়েছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলেও পাড়ার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন মুরব্বিরাই তাদের ভয় পান। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কী করে সময় কাটায়, ডিজিটাল ডিভাইসে কী করেÍতারা বুঝে উঠতে পারেন না। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর এক কর্মকর্তার মতে, ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে তাদের মধ্যে অস্ত্র চালানো শেখার ইচ্ছা জাগে। এরপরই জঙ্গিগোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে তারা ঘর ছাড়ে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশি দায়ী তা মূলত পারিবারিক। বর্তমানে শহরগুলোতে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাবা-মা উভয়েই বাসার বাইরে চাকরি, ব্যবসা তথা অর্থ উপার্জনে ব্য¯স্ত থাকেন। ফলে, সন্তান-সন্তুতি উপযুক্ত স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা আচরণে বিদ্রোহী হয়ে যাচ্ছে। সংসারে অশান্তি, অভাব, বাব-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা পৃথক থাকাও সন্তানদের নেতিবাচক মানসিকতায় প্রভাব ফেলে এবং সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যদি সুষ্ঠুভাবে কিশোরের ব্যক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে তাহলে পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিশোর অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। মূলত শিল্পবিপ-বের পরবর্তীকালে কিশোর অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন অপরাধ, অপরাধ দমন এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে।

 

১৯৫০ সালে জাতিসংঘের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কিশোর অপরাধের বিষয়ে বলা হয়– কিশোর অপরাধের সংজ্ঞার ওপর অতিশয় গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা সংঘটিত সব ধরনের অপরাধ আইন ভঙ্গমূলক এবং খাপছাড়া বা অসংগতিপূর্ণ এমন আচরণ যা সমাজস্বীকৃত নয় এসবই কিশোর অপরাধ। বাংলাদেশে দ-বিধি ১৮৬০-এর ধারা ৮২ অনুযায়ী ৯ বছরের কম বয়স্ক কোনো ব্যক্তির অপরাধমূলক কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ধারা ৮৩ অনুযায়ী ১২ বছর বয়স্ক কোনো কিশোরও যদি তার কাজের প্রকৃতি ও ফলাফল বুঝতে সক্ষম না হয় তাহলে তাকেও অপরাধী বলে গণ্য করা হবে না। শিশু আইন ২০১৩-এর ৪ ধারা বিদ্যমান ‘অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ, দ-বিধি ও শিশু আইন পর্যালোচনা করে বলা যায় ৯ বছর (ক্ষেত্রবিশেষে ১২ বছর) থেকে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ অপরাধ করলে শিশু বা কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচারপ্রক্রিয়া এবং শাস্তির ক্ষেত্রে কিশোর অপরাধীদের অন্য অপরাধীদের থেকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয় কঠোর শান্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে সংশোধনমূলক ব্যবস্থাতেই জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালে ঢাকায় ইৎড়ংঃধষ ঝপযড়ড়ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে শিশু-কিশোরদের জন্য জাতীয় শিশু আইন প্রণীত হয়। টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে সই করে। উক্ত সনদ এর বিধানাবলি বাস্তবায়নের নিমিত্ত ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিত ২০১৩ সালে সরকার একটি নতুন শিশু আইন প্রণয়ন করেছে। শিশুর মাধ্যমে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার শিশু-আদালত করবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর অধীন গঠিত প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্বীয় অধিক্ষেত্রে শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হয়। শিশু আইন অনুযায়ী বিদ্যমান কোনো আইনের অধীন কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অথবা বিচারে দোষী সাব্যস্ত কোনো শিশুকে সাধারণ জেলহাজতের পরিবর্তে নিরাপদ হেফাজতে (ঝধভব ঐড়সব) বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বা প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানে রাখার বিধান আছে। এ ছাড়া কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য বিচার চলাকালে শিশুবিষয়ক ডেস্ক, শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, প্রবেশন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করে। শিশুর বিচার চলাকালে, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফর্ম পরতে পারবেন না। বিচার কার্যক্রমের যেকোনো পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রমের পরিবর্তে শিশুর পারিবারিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক-আর্থিক, মনসতাত্ত্বিক পটভূমি বিবেচনাপূর্বক, বিরোধীয় বিষয় মীমাংসাসহ তার সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকল্পে বিকল্প পন্থা (ফরাবৎংরড়হ) গ্রহণ করার বিধান আছে। গ্রেপ্তার করার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো, কোনো শিশুকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ-সংক্রান্ত কোনো আইনের অধীন গ্রেপ্তার বা আটক করা নিষেধ।

 

শিশু আইন, ২০১৩-তে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, শোষণ, অসৎ পথে পরিচালনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। আইন যতই সংশোধনের ব্যবস্থা করুক, বিচার ব্যবস্থা যতই শিশুবান্ধব হোক, কোনো শিশু একবার অপরাধের পথে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই কোনো শিশু-কিশোর যেন অপরাধের পথে বা বিপথে যেতে না পারে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এর জন্য মূল কারিগর হচ্ছে পরিবার। সব অপরাধীই কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে থাকা চাই দীক্ষা– এই দীক্ষা শিশুরা পায় পরিবার থেকে; সমাজ থেকে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্মকে নানাবিধ অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করার প্রধান কাজটি করতে হবে পরিবারকে। সন্তান যেন বাবা-মা’র যথেষ্ট সঙ্গ পায় তার প্রতি জোর দিতে হবে। তারা কী শোনে-দেখে, কার সঙ্গে মিশে, মোবাইল-ইন্টারনেট, অনলাইন গেমস, পর্নোগ্রাফি-মাদকাসক্ত হচ্ছে কি না- এটা পরিবার ছাড়া কেউ আগে ধরতে পারবে না। একেবারে ছোট বয়স থেকেই শিশুকে বই পড়া, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা উচিত। আজকের কিশোর-কিশোরীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কোনো সন্তান পথভ্রষ্ট হলে শুধু পরিবারের জন্য দুঃখের বা কষ্টের বিষয় তা নয়– সে তো একটা সমাজের পরিবেশ নষ্ট করে, একজন আরও দশজনকে বিপথে নেয়, সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়ে। তাই সরকারও শিশু-কিশোরদের বিপথে নিতে পারে এমন অ্যাপ, অনলাইন গেমস দেশে নিষিদ্ধ করার যায় কি না বিবেচনা করতে পারে।

 

লেখক : কলামিস্ট-গবেষক।


সংবাদটি শেয়ার করুন
  •  
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com